আমরা আমাদের সন্তানকে অনেক বেশি ভালোবাসি এবং আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তান যেন সমাজে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। সমাজের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কিছুদিকে নজর রাখা উচিত।
বেশিরভাগ মা-বাবাই বেশি মনোনিবেশ করেন সন্তান স্কুলে পড়াশোনা ঠিকমতো শিখছে কি না কিন্তু আমরা প্রায় ভুলে যাই সন্তানদের ঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য আরও কিছু জিনিস মাথায় রাখা উচিত- যেমন বাচ্চা ঠিকমত সৃজনশীলতার বিকাশ হচ্ছে কিনা।
আমাদের আগের প্রতিবেদনে এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।তারই পরবর্তী প্রতিবেদন নিয়ে আজকের এই লেখা।
পদ্ধতি ১ আমাদের আগের আর্টক্যালে আলোচনা করা হয়েছে।
১. সৃজনশীলতার বিকাশ:

আপনার খুদে শিল্পীকে উৎসাহিত করুন। আপনার সন্তান যে সব আকিঁবুকি এবং ছবি আঁকছে তা কেবলমাত্র ফ্রিজে বা ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার জন্য নয়। বরং এ সবের ভূমিকা তারচেয়েও অনেক অনেক বেশি! শিল্পকলা বা ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশকে শিখছে। রঙের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। এতে সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস সহ আরও অনেক উপকারী দক্ষতা এবং গুণাবলী অর্জন করছে বা এ সব অর্জনের পথে উৎসাহিত হচ্ছে আপনার প্রিয় সন্তান।
প্রচুর রঙিন পেন্সিল, ক্রাইওন, মার্কার, রঙিন কাগজ এবং হাতের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অঢেল সরবরাহ যেন ঘরে থাকে সে দিকে নজর দিবেন। একটি কথা মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে যে, আপনার সন্তানের শিল্পকর্মের বিচার করতে বসেন নি আপনি। তাকে পিকাসোতে বা জয়নুল আবেদিনে পরিণত করা নয়; বরং মজাদার উপায়ে নিজের সৃজনশীলতা যেন সন্তানটি খুঁজে পায় – এখানে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
২.আপনার সন্তানের স্থানিক যুক্তি দক্ষতার বিকাশ করুন:

স্থানিক যুক্তি বলতে বস্তুর অবস্থান কল্পনা করার ক্ষমতা, কোনও জিনিস কীভাবে চলাফেরা করে এবং একের সঙ্গে অপর জিনিস কীভাবে লেগে থাকে তা বুঝতে পারাসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো বোঝার সক্ষমতা হয়। স্টেম বা STEM (science, technology, engineering and math, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌলশী এবং গণিত) এবং সৃজনশীলতা উভয় ক্ষেত্রেই এ যুক্তি আয়ত্ব করার প্রয়োজন রয়েছে। সন্তানের স্থানিক যুক্তি উৎসাহিত করার জন্য প্রচুর উপায় এবং অনেক পথ রয়েছে।
সন্তানকে এমন খেলনা দিন যাতে তাকে দৈহিক ভাবে চলাফেরা বা সক্রিয় হতে হয়। এ সব খেলনার মধ্যে ব্লক, লেগো, কিছু বিশেষ ধরণের ধাঁধা রয়েছে।
ঘরের বাইরে খেলাধুলা এবং ক্রীড়ায় অংশ নিতে উৎসাহি করুন।
আপনার সন্তানকে সাথে নিয়ে হাঁটার অভ্যাস করুন।
আপনার শিশুকে শিল্পকলা এবং হাতের কাজ অর্থাৎ কারুশিল্পের প্রতি উৎসাহিত করুন। তাকে মডেল তৈরি করতে দিন। খেলাধুলা, ক্রীড়া, দৈহিক তৎপরতাসহ শিল্প এবং কারুশিল্পের জগতের প্রতি উৎসাহিত করতে থাকুন।
৩.ঘর হয়ে উঠুক সংগীতময়:

শিল্পকলার মতো গান-বাজনা-সংগীতও আপনার সন্তানের কোমল অনুভূতি এবং সৃজনশীল বোধকে উস্কে দিতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবলমাত্র সঙ্গীত শোনার মধ্য দিয়ে মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশকে উদ্দীপ্ত করা যায়। তাই আর বিলম্ব নয় ঘর হয়ে উঠুক সংগীতময়।
আপনি যদি গান করেন বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজান, তবে আপনার সন্তানকে তার সঙ্গে জড়িত করুন। সংগীত সৃষ্টির কাজে তাকে জড়িত করুন। আপনার শিশু আগ্রহী হলে সংগীতে শিক্ষাও দিতে পারেন।
আপনি সংগীতের সমঝদার না হলেও ঘরে বা গাড়িতে, আপনার সন্তানের জন্য গান বাজানোর চেষ্টা করুন। তাদের সাথে গলা মিলিয়ে গান করুন!
ছোটদের ছড়া গানসহ মজার মজার গানগুলো বাজানোর চেষ্টা করুন। বিশেষ করে ছোট শিশুর সঙ্গে এ ধরণের গান শোনার বা গাওয়ার অভ্যাস করুন।
অতিরিক্ত মজা পাওয়ার জন্য, আপনার সন্তানের সাথে নাচার চেষ্টাও করুন!
৪.আপনার শিশুকে নিজের মতো খেলার প্রচুর সময় দিন:

শিশুকে দিনে অন্তত এক ঘণ্টা নিজের মতো খেলতে দেয়া উচিত। কিন্তু আর্দশগত ভাবে তাকে আরও বেশি সময় দেয়া উচিত। নিজের মতো খেলতে দেয়া হলে শিশু তার কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে। তবে শিশুর ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপাবেন না। মানে ছবি আঁকা, হাতের কাজ প্রভৃতি করতে তাকে বাধ্য করবেন না। বরং তাকে নিজের মতো খেলতে দিন।
ব্লক, লেগোসহ অন্যান্য খেলনা যুগিয়ে দিন, এ সব খেলনা দিয়ে সে নিজের মনের মতো জিনিসপত্র তৈরি করবে। এ জাতীয় খেলনা তার জন্য বড় কিছু হয়ে উঠবে।
আপনার শিশুকে নিজের মতো সাজতে দিন, পুরান গামছা মাথায় বেঁধে সে হয়ে উঠল কল্পরাজ্যের রাজা, মায়ের বাতিল শাড়ি পরে হয়ে উঠল কল্প রাজ্যের রানি, বা একটা বড় কাঠি হাতে সে নিজেকে ভাবতে লাগল, ‘আমি আজ কানাই মাস্টার।’ আর কল্পিত বেড়াল ছানাকে পড়াতে বসে গেল! হ্যাঁ তার এ ধরণের খেলাকে উৎসাহিত করুন।
আপনার সন্তানের সঙ্গে খেলতে ভয় পাবেন না। সে কল্পনার যে জগৎ তৈরি করছে তা করতে দিন। বরং তাকে সাহায্য করুন।
আপনার সন্তানকে দুনিয়া সম্পর্কে শিক্ষা দিন:
১. সন্তানকে বাইরে নিয়ে যান:

বাইরে প্রচুর সময় ব্যয় করা শিশুর বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের এবং পাশাপাশি তাদের দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্যেও সুফল বয়ে আনে। বাইরের দুনিয়া দেখার মধ্য দিয়ে আপনার শিশুর মনে আশেপাশের প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। বাড়বে তার কৌতূহল। একই সাথে মৌলিক বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আপনার সন্তানকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় এ সব জিনিস চেষ্টা করে দেখতে পারেন:
বাইরে হাঁটাহাটি করার সময় যে সব গাছলতা পাতা ও বিভীন্ন প্রাণী চোখে পড়বে তাদের সম্পর্কে কথা বলুন। সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন উদ্ভিদ এবং প্রাণী নিয়ে।
সম্ভব হলে আপনার শিশুকে গাছের ঘর বা বাইরে অন্য প্রকল্প তৈরি করতে দিন।
বাইরে হাঁটাহাটি করার সময় অসাধারণ বা আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানগুলি কোথায় কোথায় আছে তা বলুন।
আপনার সন্তানের সাথে মিলেমিশে বাগান তৈরি করুন। এ ভাবে ছাদ বাগানও তৈরি করতে পারেন।
২.আপনার সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্বমুখো করুন:

আপনার সন্তানকে চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে শিখতে সহায়তা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। পৃথিবীজুড়ে অন্যান্য সব সংস্কৃতি এবং স্থাপনা সম্পর্কে জানলে শিশু বয়স থেকেই সন্তানের বৈচিত্র্যবোধ বাড়বে। এতে সন্তানের কেবল জ্ঞানই বাড়বে না, বরং অন্যান্য মানুষকে বোঝারও ক্ষমতাও গভীর হবে। আপনি যদি আপনার সন্তানের সাথে নিয়ে ভ্রমণে বের হতে পারেন তবে এটি তাদের জন্য শিক্ষার দুর্দান্ত উপায় হয়ে উঠতে পারে। এমনকি আপনি ভ্রমণ করতে না পারলেও, আপনি তাকে দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান দিতে পারেন। বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করে, ছবি দেখে সন্তানের মানসিক গঠনকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন।
আপনার সন্তানের হাতে কচি বয়স থেকেই মানচিত্র তুলে দিন এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলুন, আলোচনা করুন।
বিশ্ব সংবাদ এবং চলমান ঘটনা নিয়ে কথা বলুন।
আপনার সন্তানকে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে বা পড়তে উৎসাহিত করুন। পাশাপাশি যে সব সংস্কৃতি নিয়ে আপনার আগ্রহ রয়েছে সেগুলো নিয়েও তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করুন।
আপনার অঞ্চলে যে কোনও বহুমুখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানে আপনার সন্তানকে নিয়ে যান।
আপনার সন্তানকে নিয়ে যাদুঘরে ঘুরতে যান এতে বিভিন্নমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আপনার সন্তানের আগ্রহ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে।
৩. ভিন ভাষা শিখুন :

দ্বিতীয় (বা তৃতীয় বা চতুর্থ) ভাষা বলার অনেক সুবিধা রয়েছে; যেমন, এতে আপনার সন্তানের কথা বলার দক্ষতা বা মৌখিক ক্ষমতা বাড়বে। বাড়বে মানিয়ে চলার সক্ষমতা বা অভিযোজন যোগ্যতা। আপনি কেবল একটি মাত্র ভাষাই জানেন। তাতেও সন্তানকে ভিন ভাষা শেখাতে বড় কোনও সমস্যায় পড়তে হবে না। ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন আপনাকে সমস্যা উতরাবার পথ করে দেবে। প্রয়োজনীয় অ্যাপ নামিয়ে নেন এবং তার ভিত্তিতে সন্তানের জন্য নতুন ভাষার ক্লাস নিন।
একটি জিনিস মাথায় রাখবেন, কোনও ভাষা শেখার কাজে জোর জবরদস্তি করবেন না। ভিন ভাষা শেখার বিষয়টি যদি আপনার সন্তান উপভোগ করেন তাহলেই কেবল শেখানোর কাজ অব্যাহত রাখবেন।
আপনার সন্তানের সাথে সাথে আপনিও যদি নতুন ভাষা শেখা শুরু করেন তা দু’জনের জন্য বেশ মজার অভিজ্ঞতা হতে পারে। নতুন ভাষা আয়ত্ত্বে আনতে হবে এবং এ ভাষা ব্যবহারে সাবলীল হয়ে উঠলেই কেবল সুফল ভোগ করা যাবে তা কিন্তু নয়। ভাষা শেখার চেষ্টার করতে যেয়েও এর সুফলগুলো ভোগ করা যাবে।